কড়া নাড়ছে মুসলমানদের বছরের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদ আসে খুশির ঝলক হয়ে; কিন্তু এবার ঈদের সময়ে আমরা যাচ্ছি এক বিশাল বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। একদিকে বৈশ্বিক মহামারী করোনা, অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পানির নিচে। বন্যায় যখন দেশের নাকাল অবস্থা ঠিক তখন চলছে পবিত্র হজের মাস জিলহজ্জ। বায়তুল্লাহ শরীফ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত। চলছে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর পর বিশ্ব মুসলিম মিলিত হলো প্রাণের উচ্ছ্বাসে। মুসলিম ঐক্যের মহামিলন হজ আমাদের একই সুতোয় বাধে। কাফন সদৃশ ইহরাম পরা পরম সৌভাগ্যবান হাজীবাবারা হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়ে পাপমুক্ত হচ্ছেন। প্রভুভক্তরা পবিত্র ঘর কাবার কালো গিলাফে প্রেমের দৃষ্টি দিয়ে নিজের ভেতরের আলো জাগ্রত করছেন।
অন্যদিকে এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎস হলো ঈদুল আজহা। মুসলিম পরিবারে শুরু হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহার তোড়জোড়। ঈদুল আজহার প্রধান কাজ প্রভুপ্রেমে পশু কোরবানি দেওয়া। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে সামর্থবানরা পশু কোরবানি দিবেন। কোরবানি ঢালাওভাবে সকলের উপর ওয়াজিব নয়। যে ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। অর্থাৎ বার্ষিক চাহিদা পূরণপূর্বক কোরবানির দিনগুলোতে (১০,১১ ও ১২ই জিলহজ্জ) যার কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা সমান নগদ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। মহান আল্লাহ প্রিয় নবীজিকে নির্দেশ দিয়েছেন- আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন। (সুরা কাওসার:২) অন্য আয়াতে এসেছে- (হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সুরা আনআম: ১৬২) কোরবানি ইসলামের মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব নবীর যুগেই কোরবানি পালিত হয়েছে। হয়তো ধরণ ভিন্ন ছিল। এটি ‘শাআইরে ইসলাম’ তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর মাধ্যমে ‘শাআইরে ইসলামের’ বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে নিজের মধ্যে থাকা আমিত্ব, অহংকার ও পশুত্ব বিসর্জন দেওয়ার নামই কোরবানি। ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের শান্তি পাওয়ার অন্যতম উদাহরণ পবিত্র কোরবানি। কোরবানি আল্লাহর নামে দেওয়া হচ্ছে ঠিক, কিন্তু পশুর গোস্ত, রক্ত, হাড় কিছুই আল্লাহর দরবারে যাবে না। কোরবানি পশুর গোস্ত মুসলমানদের জন্য বরকতময় নিয়ামত। আল্লাহর নামে কোরবানি দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় নিজেরাই সে কোরবানির ফায়দা গ্রহণ করি আমরা। কোরবানির নিয়ামত শুধু নিজের জন্য নয়, সেখানে রয়েছে আত্মীয় স্বজন গরীব মিসকিনদেরও অধিকার। কোরবানি পশুর চামড়ার অর্থে গরিব মিসকিনের মুখে হাসি ফুটে। কোরবানি একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)’র নিরেট প্রভুভক্তির উজ্জ্বল উদাহরণ কোরবানি। মরুর দুলাল, আমাদের আ’কা (সাঃ) নিজের ও উম্মতের পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতি বছর কোরবানি দিয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ। কোরবানি পশুর বরকতময় গোস্ত পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটায়। প্রভুভক্তিতে নিবেদিত হয় সব আত্মা। করোনা মহামারির এ কঠিন পরিস্থিতিতেও পশু ক্রয়ে ব্যস্ত সামর্থবান মুসলমানরা। লোক দেখানো অথবা কারো মনোরঞ্জন করার জন্য কোরবানি দিলে সে কোরবানি কবুল হবে না। তারপরও আমাদের সমাজে দেখা যায় কোরবানি পশুর দাম নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। চলে গরু-ছাগল বড়-ছোট নিয়ে তর্কাতর্কি। চলে গরুর লড়াই, গোস্ত খাওয়ার আশায় বড় গরু দিয়ে কোরবানি; এসব ইসলামের দৃষ্টিতে চরম ঘৃণিত কাজ। এ সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে একমাত্র খোদাভীতি অর্জনের জন্য স্বানন্দে কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে অনেক মুসলিম পরিবারে। খুশির বাধ ভেঙেছে ঘরে ঘরে। আশার প্রহর গুনছে কখন ১০ই জিলহজ্জের সূর্যোদয় হবে। কখন যে ঈদের নামাজান্তে আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানি দিবে একেবারেই তর সইছে না। প্রতিবছর কোরবানি দেওয়া অনেক বিত্তবান এবার বন্যার কারণে সব হারিয়ে নিঃস্ব। এবার ঈদুল আযহায় সাময়িক দুর্ভোগের শিকার বানভাসি মানুষদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই হবে প্রকৃত মুমিনের পরিচয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বানভাসি মানুষদের জন্য কোরবানি দেওয়ার ঘোষণায় পাহাড়সম দুঃখের মাঝে এক ফোয়ারা সুখ।
বানভাসিদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত বাংলাদেশের বিরতিহীন ত্রাণ বিতরণ, মানবতার সংগঠন গাউসিয়া কমিটির ত্রাণ বিতরণের সাথে কোরবানির গোস্ত বিতরণের আগাম ঘোষণা, চট্টগ্রাম রাউজানের এমপি পুত্র দরদী রাজনীতিক ফরাজ করিম চৌধুরীর উদ্যোগে মাসব্যাপী ত্রাণ বিতরণ, প্রায় ৫০০ ঘর নির্মাণ এবং ১০০ গরু কোরবানির ঘোষণা চিন্তিত আত্মায় সত্যিই আশার সঞ্চার করছে। কলেবর বৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে বলে সকলের নাম লিখতে না পারায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। যারাই বানভাসি মানুষদের পাশে আছেন সকলের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত আলেম সমাজকে মোবারকবাদ জানিয়ে ধন্য হতে চাই। আমাদের উচিৎ প্রত্যেকে অত্যন্ত এক কেজি গোস্ত বানভাসি মানুষের জন্য উপহার হিসেবে পাঠানো। দেশব্যাপী গাউসিয়া কমিটি এ গোস্ত সংগ্রহ করে বানভাসিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এ দুঃসাধ্য কাজ সহজ করে দিয়েছেন। রাসুলে পাক (সাঃ)’র সুন্নাত অনুসরণপূর্বক হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)’র অকৃত্রিম প্রভুভক্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ, সুপ্রিম সেক্রিফাইজ পবিত্র কোরবানি আমাদের জীবনকেও ত্যাগের মহিমায় উদ্বেলিত ও উদ্ভাসিত করুক। (আমিন)
লেখক: কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা
খতিব: এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরী জামে মসজিদ, রাউজান।